ভাষা আন্দোলন সাস্কৃতিক পঠভূমি দ্বিতীয় পর্ব
ভাষা আন্দোলন সাস্কৃতিক পঠভূমি
ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পঠভূমিঃ
সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে কবিতায় একুশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। একুশের বহু পূর্ব হতেই এই প্রভাব লক্ষ করা যায়। সেই মধ্যযুগের মাতৃভাষাপ্রেমী কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রথম কবিতা রচনা করেন। ‘নূরনামা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গবানি’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন:
‘যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবানি
সে সব কাহার নির্ণয়ন জানি।’
অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি রামনিধি গুপ্তর নানা দেশে নানা ভাষা বিনে স্বদেশীয় ভাষে পুরে কি আশা’, অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা। আমরি বাংলা ভাষা’ ইত্যাদি কবিতাও বাংলা ভাষার স্বপক্ষে কালোত্তীর্ণ কবিতা হিসেবে বিবেচিত। পরবর্তীকালেও কবিরা বাংলাভাষার পক্ষে নানা কবিতা রচনা করেছেন।
বাহান্ন-উত্তর কালপর্বে অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের মনস্তাত্তিক পর্বে বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালাকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো ভাষা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার পর প্রথম কবিতা লেখেন ভাষাসংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তার লেখা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতার প্রথম চরণ হলোঃ
‘ওরা চল্লিশ জন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে-রমনার রৌদ্রদগ্ধ’
মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর উক্ত পঙ্ক্তিমালা শুধু কবিতা নয়, বাঙালির আবেগ আর প্রতিবাদের সাহসী উচ্চারণ।‘অমর একুশ’কে নিয়ে অগণিত কবিরা অগণিত কবিতা রচনা করেছেন যা আজো অব্যাহত আছে। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় কিছু কিছু কবিতা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। উল্লেখ্য যে, ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ ধ্বংসের পর প্রথম কবিতা রচনা করেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কাব্যিক প্রতিবাদ-
‘স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো।’
একুশের কিংবদন্তিতুল্য কবিতা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘কোনো এক মাকে’। এই কবিতায় ভাষাশহীদের প্রতীক্ষারত মায়ের আকুতি প্রকাশ যেন দেশের সব মায়ের হৃদয়ের গভীর আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ।
‘কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে পড়েছে ডাটা;
পুঁইলতাটা নেতানো,-
খোকা এলি?
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।’
একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশের পূর্বে ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা সংকলন ‘ওরা প্রাণ দিল’। এটি ২০ বি, বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, কলকাতা-১৯ থেকে বেনু প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রকাশক-শিবব্রত সেন, প্রিন্টার্স কংগ্রেস লি. ৩ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট, কলকাতা-১ থেকে মুদ্রিত।
একুশের গল্প
রাষ্ট্রভাষা- আন্দোলনের ওপর লিখিত প্রথম গল্পের নাম ‘মন ও ময়দান’। গল্পটির লেখক কথাশিল্পী ও ভাষাসৈনিক শাহেদ আলী। ১৯৫০ সালের সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার আজাদী দিবস ও ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত যৌথ বিশেষ সংখ্যায় আমাদের ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলনের প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হয়। বহুকাল পরে জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘শা নযর’ গল্পগ্রন্থে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়।বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম শুরুর পরবর্তীকালে তৎকালীন শীর্ষপদে আসীন এক অবাঙালি আমলা এবং তার বিদ্রোহী কন্যা শিশির সংঘাতের গল্প ‘মন ও ময়দান’।মূলত এ গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ভাষার জন্য সংগ্রামের প্রতি পাকিস্তানের কর্তা ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গিইকেই তুলে ধরেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী শিরির মধ্যে দিয়ে আমরা তখনকার মানুষের সংগ্রামী চরিত্রেরই যেন প্রকাশ দেখতে পাই। পরিবারের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এ দেশ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শিরি পাঠকদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করে এবং যেন ইঙ্গিত দেয় আসন্ন বিজয়ের।১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার পর অর্থাৎ একুশের ওপর লিখিত প্রথম গল্পের নাম ‘মৌন নয়’। গল্পটির রচয়িতা বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি, গ্রন্থে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
বাহান্নার পরবতীকালে একুশ নিয়ে প্রচুর গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘একুশের গল্প’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দার, মোবারক হোসেন সম্পাদিত ‘একুশের গল্প’ নামে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৯ সালে গ্লোব লাইব্রেরি (প্রা.) লিমিটেড থেকে হায়াৎ মাসুদ, হোসনে আরা শাহেদ, শাজ্জাদ আরেফিন সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনের গল্প’ নামেও একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে নবীন, প্রবীণ গল্পকারের গল্প সংকলিত হয়েছে।
একুশের উপন্যাস
একুশের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘আরেক ফাল্গুন’। এটির রচয়িতা জহির রায়হান (১৯৬৮)। উপন্যাসটি গ্রন্থাগারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।একুশের প্রথম উপন্যাস ছাড়াও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসগুলো হচ্ছে : সেলিনা হোসেন ‘যাপিত জীবন’, ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’, মোহাম্মদ আবদুল আওয়ালের ‘আলো আমার আলো’। উক্ত উপন্যাসগুলোতে ১৯৫২ সালের ঘটনাপ্রবাহ সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এসব উপন্যাস ছাড়াও পরবর্তীকালে বেশকিছু কথাশিল্পীর লেখায় স্বল্পমাত্রায় হলেও একুশের প্রসঙ্গ এসেছে।ড. আব্দুর রহিম বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশের উপন্যাসে একুশের চেতনা কথশিল্পীদের তুলির আঁচড়ে নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হয়েছে। এ উপন্যাসগুলো শুধু ভাষা আন্দোলনের দলিল নয়, যেন প্রামাণ্যচিত্র। এগুলো ইতিহাসের মৃত অধ্যায় না হয়ে বাঙালির জীবনে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। বাঙালির জীবন সংগ্রামে এই সব উপন্যাস চিরদিন অনুপ্রেরণা জোগাবে।’একুশের উপন্যাস নিয়ে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন : ‘কবিতার মতো পরিমাণে বিপুল না হলেও বাংলাদেশের উপন্যাসেও ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসগুলোয় মূলত শিল্পিত হয়েছে সংঘবদ্ধ বাঙালির প্রতিবাদী চেতনা।’
একুশের নাটক
একুশের প্রথম নাটকের নাম ‘কবর’। নাটকটি লিখেছিলেন আমাদের দেশের সেরা অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ভাষা শহীদদের নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ ছাড়া আর কোনো সার্থক নাটক রচিত হয়নি। ‘কবর’ নাটকের চরিত্রগুলো যেমন নেতা, ইন্সপেক্টর হাফিজ, মুর্দা ফকির এবং মূর্তিগুলো বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার নায়কদের প্রতিনিধি, তাদের সংলাপ প্রতীকী ব্যঞ্চনায় তাৎপর্যপূর্ণ, যার মধ্যে দিয়ে শুধু ভাষার দাবি নয়, ভাতের দাবিও ফুটে উঠেছে, চল্লিশের দশকের দুর্ভিক্ষের জের চলেছে পঞ্চামের দশক অবধি।”ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নাটকের সংখ্যা খুবই নগণ্য তবে নাট্যকার মমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘বিবাহ’ নাটকটি উল্লেখযোগ্য। একুশ পরবর্তীকালে প্রচুর নাটক রচিত হয়েছে এবং আজো হচ্ছে। চলবে............
সহায়ক
- ড. মোঃ মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-৭১, সময় প্রকাশন, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
- দৈনিক ভোরের কাগজ, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৮।
- দৈনিক যুগান্তর, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮।
No comments
Thanks for your Comment