ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক পঠভূমি তৃতীয় পর্ব
ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক পঠভূমি
একুশের চলিচ্চিত্র
আমাদের সংস্কৃতি ও শিল্পকলার মধ্যে চলচ্চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ভাষা শহীদদের স্মরণে এবং এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারা পূর্ববঙ্গের সিনেমা হলগুলো বন্ধ রাখা হয়। ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই পরবর্তীতে জড়িত হন চলচ্চিত্রের সাথে।ভাষাসংগ্রামী জহির রায়হান ১৯৭০ সালে নির্মান করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি। এতে তিনিই সর্বপ্রথম একুশের প্রভাতফেরি মিছিল, শহীদ মিনার এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ব্যবহার করেন।এ ছবির সাফল্যের পর একুশের আন্দোলন নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নেন জহির রায়হান। এই ছবির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল ভাষা আন্দোলনে মহান শহীদদের স্মরণে রক্তের অক্ষরে লেখা অবিস্মরণীয় সেই দিনের অমর কাহিনী নিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এই ছবির অভিনেতা, অভিনেত্রীও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সরকারি অনুমতি না পাওয়ার কারণে ছবিটি আলোর মুখ দেখতে পায়নি।পূর্ববঙ্গের প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)-এর সাথে জড়িত ছিলেন ভাষাসংগ্রামী মোশারফ হোসেন চৌধুরী ও জহরত আরা। এ ছাড়াও ভাষাসংগ্রামী আলাউদ্দিন আল আজাদ, আলতাফ মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন।ভাষা আন্দোলনের চেতনার একটি চলচ্চিত্র প্রয়াস ছিল ড. আবদুস সাদেকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম কো-অপারেটিভ সোসাইটির গঠন (১৯৫৪) এবং এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আপ্যায়ন (১৯৫৪) নামে স্বপ্লদৈর্ঘ্য চিত্র নির্মাণ। ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রভাবে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ১৯৫৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলাদা ও পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। তবে চলচ্চিত্র জগতে একুশের প্রভাব লক্ষণীয়। অনুপম হায়াত যথার্থই বলেছেন : “ভাষা আন্দোলন আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেম (অবশ্য কিছু নষ্ট চলচ্চিত্র বাদে) প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে সেই ‘৫০’, ‘৬০’ ও ‘৭০’ দশকে।”
একুশের গান
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ই অমর একুশের গান। আবার মোশারেফ উদ্দিন আহমেদ রচিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল’ প্রথম প্রভাতে ফেরির গান। তবে এগুলো একুশের প্রথম গান নয়। প্রথম গানটি নিম্নরূপঃ
‘ভুলব না, ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না।
লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি ভুলবো না।’
ভাষা আন্দোলনের সূচনার গান হিসেবে এটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং তা আন্দোলনের মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। গানটির গীতিকার ছিলেন গাজীউল হক নিজেই। ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে আয়োজিত জনসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়।১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসের প্রথম প্রভাত ফিরিতে যে গানটি গাওয়া হয়েছিল। তা হলো
‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল
ভাষা বাঁচাবার তরে
আজিকে স্মরিও তারে।’
গানটির রচয়িতা ছিলেন ভাষাসংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদ। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে গানটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই গানটি এবং গানের রচয়িতা বলতে গেল আজ হারিয়ে গেছে।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি;’ এই ঐতিহাসিক গানটি লিখেছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একটি প্রথম গান হিসেবে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল কবিতা হিসেবে। গেণ্ডারিয়া দুপখোলা মাঠে যুবলীগের একটি অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম এই কবিতাটি আবৃত্তি করা হয়।পরবর্তীতে কবিতাটি সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা কিলেজের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে তৎকালীন ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে আবদুল লতিফের সুরে সর্বপ্রথম গানটি গাওয়া হয়। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
একুশের বইমেলা
একুশের বইমেলা আজ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির অংশ। ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং সোহরওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রাণের মেলা বইমেলা।১৯৭২ সালে প্রথম মুক্তিধারার সৃজনশীল সাহিত্যের অগ্রপথিক চিত্তরঞ্জন সাহা ২১ ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সঙ্গে বাংলা একাডেমির চত্বরে ঘাসের মধ্যে চট বিছিয়ে বই বিক্রির সূচনা করেন। ১৯৭৩ সালেও একই সময়ে একইভাবে তিনি একই বই নিয়ে চট বিছিয়ে বিক্রয় করেন। ১৯৭৪ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানামার সঙ্গে মুক্তধারায় প্রথম একটি বইয়ের স্টল করে বাংলা একাডেমির প্রবেশ পথের পাশে বাদিকে আম গাছের নিচে। মেলায় স্টলের আনুষ্ঠানিক সূচনা এভাবেই। আজ শত শত প্রকাশনা সেখানে ভিড় করে। মেলা হয় মাসব্যাপী। আজ এটি বাঙালির প্রাণের মেলা। মেলা কেন্দ্র করে নানারকম পুরস্কার সূচনাও করেছিলেন চিত্তরঞ্চন সাহা।১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত সর্বপ্রথম ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামক সংকলনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য দলিল। উক্ত সংকনটির রাজনীতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বহ। আমাদের দেশের সেরা শিল্পী-সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে সংকনটিতে অনবদ্য ও বর্ণাঢ্য করে তোলা হয়েছিল। সংকলনটির গুরুত্ব প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলেনঃ “শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যের কারণেই নয়, লেখার বৈচিত্র্য ও মানের বিচারেও একুশের প্রথম সংকলনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট প্রকাশনা। এখন আমরা বাংলাদেশের প্রধান লেখক হিসেবে যাদের গণ্য করি, তাদেরই লেখাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সংকলনে।”
একুশের শিল্পকলা
ভাষা আন্দোলনে এদেশের শিল্পী সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আলোকচিত্রে, পোস্টারে, ফেস্টুনে, চিত্রকলায়, আলপনায়, কার্টুনে, ভাস্কর্যে শিল্পীরা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন একুশের আবেগ আর চেতনা।ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আলোকচিত্র শিল্পীরা অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ছবি তুলেছিলেন ভাষাসংগ্রামী অজম তকীয়ুল্লাহ। ১৯৫২ সালে একুশের আন্দোলনের ঐতিহাসিক ছবি তুলেছেন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দীনের মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার বীভৎস ছবিটি তুলেছিলেন আমানুল হক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলের ছবি এবং প্রথম শহীদ মিনারের ছবি তুলেন অধ্যাপক এম আই চৌধুরী এবং ডা. এ হাফিজ। তা ছাড়া ১৯৫৩ সালের প্রথম শহীদ দিবসের কিছু ছুবি তুলেন ভাষাসংগ্রামী ডা. এমদাদুল হক।১৯৫২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পর পরই তৎকালীন শাসকচক্রের বিরুদ্ধে পোস্টার লেখা শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের অনভিজ্ঞ ছাত্ররাও পোস্টার লিখে দেয়ালে দেয়ালে টানিয়ে দেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকরা।‘একুশ নিয়ে গান-কবিতা-ছড়া, গল্প উপন্যাস-নাটক লেখা হয়েছে। চলচ্চিত্রেও একুশ এসেছে কিন্তু সবার আগে এসেছে চারুশিল্পে। জনতার মিছিলের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানারে খচিত হয়েছে দ্রোহী শিল্পীর মনের আবেগ। ৫২’র মিছিলে গুলি চালানোর ঘটনা আগে থেকেই প্রতিবাদী পোস্টার লেখতেন শিল্পীরা। গুলি চালানোর পর লেখার পাশে ইমেজ এল। চিত্রিত হলো করুণ দৃশ্য, কখনো শিল্পীদের ক্ষোভ প্রকাশ পেল ব্যঙ্গ বিদ্রুপে। পোস্টার লেখার সামগ্রী জোগাড় করাও সহজ ছিল না। পুরনো খবরের কাগজের ওপর লাল বা কালো রং দিয়ে লেখা হতো সেসব পোস্টার। এ পোস্টার লেখা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকেই। কামরুল হাসান বলেছেন, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীরাই সেগুলো লিখতেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই প্রথম আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন, রশীদ চৌধুরী পোস্টার লিখেছেন। এদের তুলির বলিষ্ঠ রেখায় পোস্টার শিক্ষাঙ্গনে, রাস্তায়, গলিতে সেঁটে দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে করা হয়েছে আরো প্রাণবন্ত।’
একুশকে স্মরণ করে, কিংবা বলা যায় একুশকে অবলম্বন করে শিল্পীদের রঙ তুলির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা কিংবা আঁকা চিত্রকর্মের বিষয়গুলোর মধ্যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বুটের নিচে পিস্ট বাংলা বর্ণমালা, মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য নিবেদিত প্রাণ সংস্কৃতি কর্মীর মুখ কিংবা দেহ, পোস্টারসহ গুলিবিদ্ধ লাশ, কর্তৃক বাংলার সংস্কৃতির ওপর ছোবল, প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পী অংকিত এ সবচিত্র বাংলাপ্রেমী সব মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে অধিক মাত্রায় বেগবান করেছে। যখন কোনো মানুষ শিল্পীর অঙ্কিত মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে বীরদর্পে অগ্রসরমান নরনারীর মিছিলের সম্মুখীন হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লিখিত ব্যানারসহ রাজপথে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা লাশের সম্মুখীন হয়েছে।’“জয়নুল-কামরুল থেকে নিয়ে একেবারে তরুণ শিল্পীরাও লোকজ শিল্পের ফর্ম, রং, রেখা, প্রবণতা এ সবকে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভাস্কর্যে পোড়ামাটি ও কাঠের কাজ বিশেষভাবে নিজস্বতার দাবি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে যে সংস্কৃতিক শক্তি, প্রেরণা এবং অনিবার্যতা প্রয়োজন, সেটি ভাষা আন্দোলনই দিয়েছে।”২১ ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। একুশের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমানেও বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একুশের চিত্র ও ভাস্কর্য নির্মাণে সৃজনশীলতার ও মননশীলতার পরিচয় বহন করে চলেছে এ দেশের শিল্পী সমাজ।
একুশে উদযাপানের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘আলপনা’। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায়, দেয়ালে আল্পনা আঁকা আজ আমাদের সংস্কৃতির অংশ, যদিও পাকিস্তান আমলে এই আল্পনা আঁকায় বাঁধা এসেছে। এ প্রসঙ্গে শিল্পী হাশেম খান বলেন, “শহীদ মিনার ও প্রভাতফেরির রাস্তায় ‘আলপনা’ দ্রোহের ভাষা। প্রতিবাদের ভাষার রূপ নিয়েই চারুশিল্পীরা নিয়ে আসে। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে শহীদ মিনার চত্বর ‘আলপনা’ এঁকে পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। খালি পায়ে প্রভাতফেরির পথ আলপনা সমৃদ্ধ করে রাখাটা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক দিন থেকেই বিবেচিত।”রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৯ সালে প্রথম কার্টুন অঙ্কন করেন শিল্পী কাজী আবুল কাসেম। কার্টুনটির নাম ছিল ‘হরফ খেদা অভিযান’। ১৯৪৯ সালের পর থেকে শিল্পী আবুল কাসেমকে আমরা নিয়মিত কার্টুন শিল্পী হিসেবে পাই। তিনি দৈনিক পত্রিকায় ‘দো-পেয়াজা’ ছদ্মনামে বহু কার্টুন এঁকেছেন। ‘হরফ খেদা অভিযান’ শিরোনামে কার্টুনটি বাংলা ভাষা ধ্বংসের অপকৌশল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রে দেখা যায়- লীগ সরকার ও তার আমলারা তলোয়ার নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাংলা ভাষাকে তাড়ানোর জন্য। তাদের সামনে দুটি বই হতে বাংলা বর্ণমালা ক, খ, চ, ছ বর্ণগুলো তাড়াচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের তাড়াচ্ছে। এর অর্থ বাংলা ভাষা শেষ করা মানে সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা। কারণ মাতৃভাষাই সংস্কৃতির বাহন। ভাষাকে তুলে দিতে পারলেই অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে যাত্রা করবে।কাঠখোদায় করে যিনি একুশের প্রথম শিল্পকর্মকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি হলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সোমনাথ হুড়। উক্ত শিল্পকর্মটির শিরোনাম হলো ‘বাংলা ভাষার কণ্ঠরোধ করা চলবে না’।‘উটকাঠ’ নামের এই শিল্পকর্মটিতে একজন প্রতিবাদী ভাষাকর্মীর মুখে ক্ষোভ ও ঘৃণার ছাপ লক্ষ করা যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে একজন ভাষাশহীদ। চারপাশে রক্তের ছাপ। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাষাকর্মীর এক হাতে ‘বাংলা ভাষার কণ্ঠরোধ চলবে না’ গানটি শোভা পাচ্ছে। উক্ত শিল্পকর্মটির ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ওরা প্রাণ দিল’ শীর্ষক একুশের প্রথম কবিতা সংকলনে। এই সংকনটি ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়নি। সোমনাথ হুড় ছিল তৎকালীন বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী, ফলে নিরাপত্তার কারণে সংকনটিতে খেলা ছিল ‘প্রচ্ছদ পট এনেছেন : গণআন্দোলনের অংশীদার জনৈক শিল্পী।’ এই জনৈক শিল্পীই হলেন সোমনাথ হুড়। একুশের প্রথম লিনোকাট (ছাপচিত্র) অঙ্কন করেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, বায়ান্নার ভাষাকর্মী মুর্তজা বশীর। লিনোকাটটির শিরোনাম হলো; ‘রক্তাক্ত একুশ’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ প্লেকার্ড বহন করে একদন ছাত্রজনতা একুশের মিছিলে অংশগ্রহণ করছে। মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে একজন ছাত্রনেতা গান সংবলিত প্লেকার্ড নিয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং শহীদ হয়। চিত্রটিতে শহীদের পায়েরও রক্তের ছাপ বিদ্যমান। ছাত্রনেতার হাত থেকে বইটি মাটিতে পড়ে বইটিও রক্তাক্ত হয়ে যায়।
- ড. মোঃ মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-৭১, সময় প্রকাশন, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
- দৈনিক ভোরের কাগজ, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৮।
- দৈনিক যুগান্তর, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮।
ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক পঠভূমি প্রথম পর্ব
ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক পঠভূমি দ্বিতীয় পর্ব
No comments
Thanks for your Comment