ভাষা আন্দোলন সাস্কৃতিক পঠভূমি প্রথম পর্ব

ভাষা আন্দোলন সাস্কৃতিক পঠভূমি



     ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের আত্মজাগরণের ইতিহাস ভাষা আন্দোলনের এই গৌরবদীপ্ত ইতিহাসে দেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী সমাজের ভূমিকা ছিল খুবই স্মরণীয় তা ছাড়া আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি শিল্পকলার ক্ষেত্রে বাহান্নর ভাষা সংগ্রাম অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের এমন কোনো কবি, লেখক শিল্পী খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি অমর একুশে নিয়ে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করেননিএকুশের হত্যাকাণ্ডের পরপরই তারা একদিকে যেমন ধর্মঘটসহ প্রতিবাদে, বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন অন্যদিকে কলম আর তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন একুশের আন্দোলনের নানামাত্রিক চিত্র-চরিত্র আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা শাখায় প্রতিফলিত হয়েছে তাদের সৃজনকর্ম এক কথায় বলতে গেলে, একুশের বৈপ্লবিক চেতনা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে এবং এই চেতনার স্পর্শে আলোকিত বিকশিত হয়েছে হচ্ছে আমাদের সাহিত্যালোক, সংস্কৃতি শিল্পাঙ্গন নিম্নে সাহিত্য-সংস্কৃতি শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটঃ বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পেছনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় পূর্ব বাংলায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে সেপ্টেন্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ছাত্রের উদ্যোগে তমুদ্দুন মজলিস গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় এবং সে আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা আসে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভাষা-সংস্কৃতি হারানোর উপক্রম হয় পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে সেদিন বাঙালি জাতিকে নতুন করে যে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তার পরিণাম ছিল ভয়াবহ পাকিস্তানি নব্য উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার অব্যাহত রাখে তাদের প্রথম ফন্দি ছিল কীভাবে বাংলার মানুষের মুখের ভাষাকে ছিনিয়ে নেয়া যায় এরই অংশ হিসেবে তারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালির ঘাড়ে পাকিস্তানি Culture চাপিয়ে দেয়ার নীলনকশা অঙ্কন করে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা দেন; ‘Urdu & Urdu shall be the state language of Pakistan’. কিন্তু এদেশের ছাত্র-যুবকরা সে সমাবেশেই No, No, It can't be ধ্বনি তুলে তার ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তানি সরকার সব প্রতিবাদকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায় তাদের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এদেশের মানুষ বাংলার দামাল ছেলেরা শুধু নয়, সর্বস্তরের মানুষ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্র কঠিন শপথ গ্রহণ করে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় ছাত্র যুবসমাজসহ সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ পূর্ব বাংলায় তিনটি পর্যায়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়

প্রথম পর্যায়ঃ ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনে উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং দাবি পূরণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করা হয় সংগ্রাম পরিষদের দাবি ছিল-
. বাংলা ভাষা হবে পূর্ব বাংলার একমাত্র শিক্ষার বাহন অফিস-আদালতের প্রধান মাধ্যম
. গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা উর্দু সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই আন্দোলন পরিচালিত হয়

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা বিশেষত কুমিল্লার একজন সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানান কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান দাবির বিরোধিতা করেন ফলে ঢাকায় ছাত্রসমাজ বুদ্ধিজীবী মহলে চরম অসন্তোষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে তারপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয় সংগ্রাম পরিষদ এভাবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন অব্যাহত রাখে একপর্যায়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন সাময়িক প্রশমিত হয় কিন্তু ১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের একটি জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুনরায় ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর আন্দোলন পুনরায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের ঝড় প্রবাহিত হয়

চূড়ান্ত পর্যায়ঃ ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেয় ১৯৫০ ১৯৫২ সালে ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নতুন করে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এতে বাঙালি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন আরও জোরদার করার শপথ গ্রহণ করে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি ঘটান ফলে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে নিদারুণ ক্ষোভ হতাশার সৃষ্টি হয় আন্দোলনের গতিবেগ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৩০ জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় এবং জনসভা করা হয় আন্দোলনকে আরও তীব্র গতিশীল করার লক্ষ্যে ৩০ জানুয়ারির জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় গঠিত কমিটির সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন এবং দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচি বানচাল করার লক্ষ্যে তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমীন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সরকারের অশুভ কর্মকাণ্ডের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান করা হয় সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয় সে দিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমান্বয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ ওই সময় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল ঢাকায় ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি জোর কদমে এগিয়ে চলে প্রাদেশিক ভবন অভিমুখে সে দিন ঢাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে পুলিশের গুলির আঘাতে একে একে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর প্রমুখ যুবকরা বুকের ফিনকিঝরা তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচঢালা কালো পথ বাংলার মানুষের রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া কালি দিয়ে লেখা হয় এক অনন্য ইতিহাস অবশেষে তীব্র বিক্ষোভের মুখে পাকিস্তান সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় সাময়িকভাবে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উপস্থাপন করা হয় প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় তারপর সাংবিধানিকভাবে ১৯৫৬ সালে সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। চলবে............


সহায়ক
  • . মোঃ মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-৭১, সময় প্রকাশন, ৩৮/-ক বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
  • দৈনিক ভোরের কাগজ, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
  • দৈনিক যুগান্তর, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮


No comments

Thanks for your Comment

Powered by Blogger.