স্মৃতি কথা
জীবন চলার পথে কত ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমরা অনেককে ভূলে যাই আবার অনেকের সাথে যোগাযোগ হয় না। এমনও অনেকে আছে যারা একসময় খুব কাছের ছিল। যার সাথে অনেক বেশি মায়া, আবেগ, সুখস্মৃতি, দীর্ঘ সময় এক সাথে কাটানোর মত সুখানুভূতি আছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমরা তা ভূলে গেছি। অথবা যোগাযোগ নাই।
লোকাল ট্রেন একটা এমন যায়গা যেখানে না উঠলে মানুষ তার দেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোককে জানতে পারবে না। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য আমাদের লোকাল ট্রেন একমাত্র ভরসা। লোকাল ট্রেনে শুধু মধ্যবিত্ত না নিম্নবিত্ত থেকে ফকির পাগল এবং সমাজের যত নিচু লোক আছে সবাই লোকাল ট্রেনে উঠে। তাই লোকাল ট্রেনে না উঠলে এদের আপনি জানতেই পারবেন না।
প্রায়মারী পাশ করার পর বাবার মাদ্রাসায় (বাবা যে মাদ্রাসার শিক্ষকতা করেন) ভর্তি হই। তখন থেকেই লোকাল ট্রেনের যাত্রা শুরু। বাবা, বাসা থেকে প্রায় অনেক দূরে মানে রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার পাওটানা ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। আমরা প্রায় সব ভাই কম বেশি এই মাদ্রাসায় কয়েক ক্লাস হলেও অধ্যায়ন করেছি। আর আমার জুনিয়র দাখিল (নিম্ন মাধ্যমিক) দাখিল (মাধ্যমিক) আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) ফাজিল (স্নাতক) সব গুলো কোর্স এই একটা মাদ্রাসা থেকে করা। তাই এই পাওটানা মাদ্রাসা নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। তবে আজ ওদিকে যাব না। এই দীর্ঘ সময়ে পাওটানায় যাতায়াতের অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল ট্রেন।
লালমনিরহাট থেকে পাওটানায় অর্থাৎ পীরগাছা উপজেলা যাওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হল ট্রেন। অন্য রাস্তা আছে তবে সেই রুটে আগে খুব কম যানবাহন পাওয়া যেত। এখন ইলেকট্রিক অটোর সুবাদে সেই সমস্যা ঘুচলেও ট্রেন কিন্তু নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম। কাজেই আমাকে দীর্ঘ ১১ বছর পাওটানায় যাতায়াত করতে হয়েছে আর যার আশি শতাংশই আমি ট্রেনে যাতায়ত করেছি।
আর আমি একটা কথা অনেককে বলে থাকি আমি কোন কিছুর জন্য বা কারো জন্য অপেক্ষা করে করে থাকি তো তালিকার প্রথমে থাকবে ট্রেন আর দ্বিতীয় স্থানে থাকবে আমার বন্ধু সাজু তৃতীয় ও চতুর্থ এখনো হিসাব করিনি। আমার জীবনের অপেক্ষা করতে যতটা সময় গেছে তার বিশাল একটা সময় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে কেটে গেছে এবং এখনো যায়, কারন আমি এখনো ট্রেনে যাতায়াত করি।
একবার আমি পাওটানা যাচ্ছি সম্ভবত ফাজিল প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেয়ার জন্য। বরাবরের মত এই যাত্রায় আমার বড় সঙ্গি পদ্মরাগ ট্রেনে উঠেছি। ফেরার পথে পদ্মরাগ এর যাত্রা শুরু লালমনিরহাট থেকে হওয়ার সিট পেতে কোন সমস্যা হয় না। আমি ট্রেনে উঠে বসলাম কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি যে বগিটাতে উঠেছি এটার সিট গুলো মাঝখানে লম্বা তিন সারি। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই এই বগিতে উঠেছি। কারণ এই বগিতে উঠলে এক সাথে পুরো বগির লোকদের দেখা যায় আর একটু কোলাহল বেশিই থাকে। আমি জানালার পাশে বসেছিলাম। আর বহিরের দৃশ্য দেখছিলাম। আমার এই ট্রেন যাত্রা ছিল দীর্ঘ বেশ কয়েক মাস বিরতির পর। কারণ আলিম পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য পাওটানায় যাতায়ত কম হয়।
পরিচিত রোড পরিচিত প্রকৃতি কেমন যেন নতুন নতুন মনে হল। দেখছি আপন মনে, আর ফেলে আসা দিন গুলোর কথা ভাবতেছি। প্রথম বাবার হাত ধরে এই রুটে ট্রেনে মাধ্যমে যাত্রা শুরু, আরও অনেক কিছু ভাবছিলাম। হঠাৎ বগির ভিতরে একটু চিল্লাচিল্লি শুনে চোখ ফিরিয়ে দেখি একটা ছোট বাচ্চা প্রাকৃতিক কাজ সেরেছে। এতে কেউ ছি ছা মন্তব্য করছে কেউবা সরে যাচ্ছে আবার কেউ পরামর্শ দিচ্ছে কি করা যায়। এখন তো এই দৃশ্য চোখে পরে না। প্যাম্পার্স (কিড স্যানিটারি ন্যাপকিন) নামক বস্তুটি আসায় মায়েদের অনেক সুবিধা হয়েছে বাচ্চাদের নিয়ে আর এমন বিদঘুটে অবস্থায় পড়তে হয় না। বাচ্চাটা একেবারে আমার কাছেই কাজ সেরেছে একটুতেই আমার শরীরে লাগেনি। আমি ওখান থেকে সরে অন্যখানে চলে এলাম।
আবারও একটা জানালার পাশ দেখে বসলাম। এবার যেখানে বসলাম পাশে ছোট কিউট একটা বাচ্চামেয়ে বসে আছে। সে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছে আর আপন মনে কি যেন ভাবছে। মুখে বিরবির করে কি যেন বলছে। ছোট বাচ্চা গুলো অনেক বেশি কিউট হয়। আর তারা যখন কথা বলতে শিখে আর হাজার রকম প্রশ্ন করে তখন আরও সুন্দর লাগে। কি জানি বাচ্চাদের উপর কোন স্বর্গীয় প্রভাব আছে কিনা যার কারণে বাচ্চারা অনেক বেশি মায়াময় হয়। আমি তার এই আপন মনে কথা বলতে দেখে নাম জিগ্যেস করলাম।
-তোমার নাম কি?
-আমার নাম রোজি।
আমার কথার উত্তর দিয়ে আবারও আপন মনে বিরবির করতে লাগলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি খুব ভালো লাগছে কেমন যেন একটা টান কাজ করতেছে। আমি দেখতেছি, মেয়েটা হালকা ডিজাইনের একটা জামা পড়েছে। দেখে গরীব কোন পরিবারের বলে মনে হচ্ছে না। আবার খুব বেশি বড়পরিবারের যে নয় তাও বোঝা যাচ্ছে। আর লোকাল ট্রেনে তো মধ্যবিত্ত থেকে নিচের ছাড়া উপরের লোকেরা তো উঠে না। আমি মেয়েটার বাবা মা কে খুজতে লাগলাম পাশে বসানো কাউকে তার আত্মীয় বলে মনে হল না।
এপাশ ওপাশ তাকাতে গিয়ে দেখি একটা হকার কিছু বই বিক্রি করছে ছোটদের বই, ইসলামী বই, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, আরও নানান রকমের বই। লোকটাকে দেখে চিনতে পারলাম। আগে হকারটা পত্রিকা বিক্রি করত। আমি যেদিনই ট্রেনে উঠতাম একটা পত্রিকা নেয়ার চেষ্টা করতাম, আর যখনই কোন পত্রিকাওয়ালা মনে মনে খুজতাম তখনি হকারটার সাথে দেখা হত। আর আমি যে পত্রিকাটা নিতাম সব হকারের কাছে থাকত না। তাই বলা যায় আমি হকারটার নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম। এমন করে হকারটার সাথে একটা পরিচয় হয়েছে বলা যায়। যদিও কখনো কেউ কারও নাম বা ঠিকানা জিগ্যেস করার প্রয়োজনবোধ করিনি। আগে যখন নিয়মিত আসতাম তখন প্রায় দিনই পত্রিকা নিতাম। তার সাথে ব্যপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে এরপর ট্রেনে উঠলে এবং হকারটার সাথে দেখা হলেই আমার সেই পত্রিকা বের করে দিত।
হকারটা আমার কাছাকাছি চলে এসেছে আমাকে চিনেছে কিনা জানি না, তবে আমায় জিগ্যেস করল বই নেবেন? কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল মনে হয় চিনেছে। আমি কৌতহল রাখতে না পেরে জিগ্যেস করলাম আপনি আগে পত্রিকা বিক্রি করতেন না?
-হুঁ, ছেড়ে দিয়েছি, এখন বেশি পত্রিকা বিক্রি হয় না। বেশিরভাগ সময় অনেক পত্রিকা থেকে যায় তাই লস হয় অনেক।
-ওহ, কতদিন হল পত্রিকা ছেড়েছেন?
-তবু এক বছর তো হবে।
হকারটা আমার সামনে সিটে বসে পড়লো, মনে হয় খুব ক্লান্ত। আমি আর কিছু জিগ্যেস করলাম না। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই নেমে যাবে। এই এতটুকু সময় হকারটা একটু জিরিয়ে নিতে চাচ্ছে। চিন্তাক্লিষ্ট, রোগাক্রান্ত, রোদে ঝলসানে চেহারা দেখে ভাবতেছি আমি আমার পরিবারে জন্ম না হয়ে এরকম কোন পরিবারে হলে ঠিক এমনি কোন ট্রেনের হকার হওয়া লাগতো। নয়তো অন্যকোন দিনমজুর।
ট্রেন থামতেই হকারটা নেমে গেল। এই হকাররা আমাদের একটা স্টপেজের সঙ্গি হয়। এই একটা স্টপেজে তাদের কত ধরনের লোকের সাথে যে তাদের দেখা হয়, তাহলে পুরো ট্রেনে কত লোকের সাথে? একটা ট্রেনের সব গুলো বগি ঘুরা শেষ হলে অন্য আর একটা ট্রেনে উঠে পড়ে। তাদের কে মানুষের শ্রেণি বিভাগ করতে দিলে তারাই বোধহয় খুব ভালো বর্ণনা করতে পারবে। আর এই হকাররা শিক্ষিত না হয়েও মনে হয় মানুষের মাইন্ড রিড করতে পারে। ট্রেন আবার ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎ মেয়েটার ডাকে তার দিকে তাকালাম।
-ভাইয়া, আকাশের রং নীল কেন?
আমি প্রশ্ন শুনে অবাক! এই পিচ্ছি মেয়ে এত কঠিন প্রশ্ন করবে ভাবিনি। আমার যে জানা নেই তা নয়। তবে এত ছোট মেয়ের থেকে এই প্রশ্ন আশা করা যায় না। আমি কি উত্তর দিব ভাবতেছি কারণ তাকে নীল কেন বুঝাইতে গেলে মৌলিক রং, তারপর রংধনুর সাত রং, কোন রংয়ের বিস্তৃতি বেশি কোনটার কম সব বুঝাতে হবে। আমি এত কিছু না বলে বললাম।
-আকাশ নীল কারন আমরা শুন্যে নীল রং টা বেশি দেখি তাই।
উত্তর টা দিয়ে আমি নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। মনে মনে ভয় ধরে গেল এই প্রশ্নের পিছনে আবার কোন প্রশ্ন করে কিনা। বাচ্চারা একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে অনেক সময় তা জঠিলতা সৃষ্টি করে। কেননা তাদের স্বাভাবিক ব্যাখ্যায় বুঝাইতে গেলে তাদের অপরিচিত অন্য কোন শব্দ আসলে আবার সেটা নিয়ে প্রশ্ন করবে। তবে এই বাচ্চাটা সেরকম মনে হল না।
-ভাইয়া গাছ জমি সবগুলো কেমন যেন আমাদের পিছে যাচ্ছে আর মেঘগুলো আমাদের সাথে যাচ্ছে?
-আমরা ট্রেনে উঠেছি তাই ট্রেন চলার কারণে কাছের জিনিষ গুলো পিছনে পড়ছে কিন্তু মেঘ গুলো তো কাছের না তাই বিভিন্ন যায়গা থেকে দেখা যায় তাই মনে হচ্ছে সাথে চলছে।
এরকম আরও অনেক প্রশ্ন করেই চলল। এবার বিপরীত পাশে বসা একটা মহিলা বলল ও একটু ওরকমি ওর বাবাকে যে কত প্রশ্ন করে? আজ তোমাকে পেয়েছে বলে আমি প্রশ্ন থেকে বেছে গেছি। তারপর মহিলাটার সাথে পরিচয় হল। ওনার স্বামীর বাড়ি গাইবান্ধা স্টেশন এর পাশে। পেশায় পুলিশের এসআই। লালমনিরহাটে ওনার বাবার বাড়ি। আমার সম্পর্কে জিগ্যেস করলো। কি করি কোথায় যাচ্ছি বাসা কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
পীরগাছার কাছাকাছি আসায় আমি ট্রেন থেকে নামার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। মহিলাটা তার বাচ্চাকে বলল রোজি তোমার ভাইয়াকে টাটা দাও। ভাইয়ার মোবাইল নাম্বার নাও পড়ে কথা বলবা। আমি আমার মোবাইল নাম্বার টা দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম।
এরপর বেশ কয়েকদিন ফোন দিয়েছিল। জিগ্যেস করত কেমন আছি, নাই। বাসায় ডাকত। কয়েকদিন পরপর ফোন দিত। বেশ ভালই কথা বলত। কথা গুলো ছিল খুব পাকনা পাকনা। মাঝে মাঝে বলত ভাইয়া আপনি তো আমায় ভুলে গেছেন। মনেই পড়ে না। এভাবে বেশ দুই বছরের মত যোগাযোগ ছিল। এর মাঝে মোটামুটি পরিচয় হয়ে গেছে। রোজির মায়ের সাথেও কথা হত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় আমার আর ফোন দেয়া হয় নাই। এরপর ক্রমান্বয়ে যোগাযোগ কমতে থাকে। অনেক বার তাদের বাসায় যাওয়ার মনস্থ করেও যাওয়া হয়ে উঠে নি। অনেকদিন পর একবার ফোন দিলাম তো একটা ছেলে রিসিভ করল। রোজির কথা জিগ্যেস করলে আর বলতে পারলো না। এভাবে পরিচিত মানুষগুলো হারিয়ে যায়।
No comments
Thanks for your Comment