সামন্ততন্ত্রের, এর উদ্ভব ও বিকাশ

সামন্ততন্ত্র মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সামন্ততন্ত্র ইউরোপের ইতিহাসে এতটাই উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে, মধ্যযুগকেই অনেক সময় সামন্ততন্ত্রের যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়। এটি ছিল এক প্রকার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। যা সমগ্র মধ্যযুগ ব্যাপী অর্থাৎ নবম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর ব্যাপী ইউরোপীয় রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন এবং তাদের আচার আচারণ ও ভাব ধারার উপর বিশেষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। দশম শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে বৃহৎ ভূস্বামীর অধিনে চলে যায়। এদের অধিনে অগনতি কৃষককূল সব জমি চাষাবাদ করলেও উৎপাদিত ফসলের অধিকাংশই সামন্ত প্রভুদের দিয়ে দিতে হত।

সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞাঃ ইংরেজি Feudalism শব্দটির বাংলা অর্থ সামন্ত প্রথা বা সামন্ততন্ত্র। Feudalism শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন Feodalis ও ফরাসি Feodalite শব্দ থেকে। সামন্ত প্রথা মূলত একটা সরকার ব্যবস্থা। যেখানে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসন নয় বরংচ স্থানীয় ভূস্বামীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত থাকা। সামন্ত প্রথাকে প্রাচীন দাসভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে বিকাশিত সমাজ এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে বেড়ে উঠা সমাজের অন্তবর্তী কালীন ব্যবস্থা হিসেবে মনে করা হয়। তবে যথাযত ভাবে সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া অত্যন্ত দূরহ ব্যপার। কারণ সামন্ততন্ত্রকে একক কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

তাছাড়া ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন যে, দশম ও একাদশ শতকে ইউরোপে যে বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল তাই সামন্তব্যবস্থা। জার্মান ঐতিহাসিক জ্ঞানশপ বলেন, 

মধ্যযুগে ইউরোপে কতগুলো অদ্ভদ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল যা বিকাশ লাভ করেছিল একখন্ড জমিকে কেন্দ্র করে।

এর অর্থ একজন আর একজন কে জমি দান করবে এবং জমি প্রদানকারী হচ্ছে লর্ড আর যিনি গ্রহণ করছেন তিনি হচ্ছেন ভ্যাসাল। এই লর্ড ও ভ্যাসালের মধ্যে যে সম্পর্ক তার ফলে যে ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল তাই হল সামন্ত ব্যবস্থা। সুতরাং সামন্ত বলতে আমরা বুঝি এমন কতগুলো প্রথা বিধি ও ব্যবস্থার সমষ্টি যেখানে শক্তিশালী মানুষ দূর্বল মানুষকে সাহায্য করবে এবং এর বিনিময়ে দূর্বল মানুষ শক্তিশালী মানুষকে সেবা করবে।

সামান্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশঃ সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব কোথায় কিভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের চারণভূমি ছিল ফ্রান্স। পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপ ও এশিয়ার কোন কোন এলাকায় এ প্রথার বিস্তার লাভ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। খ্রিস্টিয় পঞ্চম হতে দশম শতকের মধ্যে। এছাড়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যথাঃ- চীনে তৃতীয়, ভারতে চতুর্থ ও পঞ্চম এবং মধ্যপ্রাচ্যে নবম ও দশম শতকে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে একাদশ ও জার্মানিতে দ্বাদশ শতকে এ প্রথার প্রথার প্রবর্তন হয়। প্রথম দিকে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ মন্থর হলেও পরবর্তীতে তা গতিশীল হয়ে উঠে।

সামান্ততন্ত্রের উদ্ভব হঠাৎ করে হয়নিঃ একটি মানব সমাজের একটি বিকাশিত পর্যায়কে বলে সামন্ততন্ত্র। তবে সামন্ততন্ত্র উদ্ভবের ক্ষেত্রে রোমান সম্রাজ্যের পতন ও তৎপরবর্তী ইউরোপের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। পঞ্চম শতকের প্রাম্ভে অষ্টোগত, ভিসিগত ভেন্ডাল এবং টিউটন প্রভূতি জার্মান জাতির উপর্যপুরী আক্রমণে রোমান সম্রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান নেতা অডোত্রকার সর্বশেষ রোমান সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টুলাসকে অপসারণ করে রোমের সিংহাসন দখল করেন। বর্বর জার্মান জাতির আক্রমণের ফলে সমগ্র ইউরোপেতে এক চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের ভিত্তি দূর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ে সমাজ জীবনে দেখা যায় এক চরম নিরাপত্তাহীনতা। জনগন তখন এমন কোন শক্তির আকাঙ্ক্ষা করেছিল যা তাদেরকে যেকোন শর্তে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে। স্বীয় শক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম এমন অনেক ভূস্বামীর নিকট তখন ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষকগণ তাদের সবকিছুর বিনিময়ে জীবনের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এরূপ চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।

অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জার্মান ও রোমান সমাজব্যবস্থার সংমিশ্রণে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। রোম দখলের পর দীর্ঘদিন রোমানদের সাথে একত্রে বসবাসের ফলে উভয় জাতির সংমিশ্রণে একটি মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠে। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট হাতিয়ার ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি জার্মানরা রোমানদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করে। জার্মানরা রোমানদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি দখল করে নেয়। রোমান কৃতদাসদের মুক্ত করে দিয়ে জার্মানরা তাদের প্রত্যেককে ছোট ছোট ভূখন্ড প্রদান করেন। বিনিময়ে তারা জার্মান ভূস্বামীকে নির্দিষ্ট পরিমান খাজনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এভাবে সামন্ত প্রভু ও ভূমিদাসদের মধ্যে বৈশম্যের সৃষ্টি হয়।

রোমান সম্রাজ্যের পতনের যুগে জার্মান বর্বরদের আক্রমণের ফলে কৃষিকাজ ও ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক সংকট ও জনগনের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে বিপুল সংখ্যক কৃতদাসের ভরণপোষণ করা ভূস্বামীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কৃতদাস শ্রমনির্ভর বড় বড় কৃষিখামার গুলো ভেঙ্গে পড়ে। অন্যদিকে নিজেদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার প্রয়জনে ক্ষুদ্র ও স্বাধীন কৃষকদের অনেকেই জমিজমাসহ শক্তিশালী ভূস্বামীদের নিকট সমর্পণ করে। জমি প্রাপ্তির বিনিময়ে ভূস্বামীরা ঐ কৃষকদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতেন এবং জমিটি চাষাবাদের জন্য আবার ঐ কৃষকেই ফেরত দিত। উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ ভূস্বামীকে দিতে হত। তবে জমি ভোগ ও ব্যবহার করার অনুমতি পেলেও মালিকানা থাকত ভূস্বামীর হাতে। তিনি ইচ্ছা করলে যেকোন সময় জমি হতে কৃষকদের উচ্ছেদ করতে পারতেন।

সামন্ততন্ত্র দ্রুত বিকাশ সাধিত হয় মেরোভিঞ্জিয়ান বংশীয় ফ্রাঙ্ক শাসক ক্লভিসের মৃত্যুর পর তার দূর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে। ফ্রাঙ্করা যখন পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করে তখন সেখানে প্রিকেরিয়াম ও প্যাট্টোসিনিয়াম প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে পিতৃভূমিতেও তারা পারস্পারিক দায়িত্বপালন ও আনুগত্যের সম্পর্ক ভিত্তিক কমিটেটাস (Comitatus) নামক একটি প্রথার সাথে পরিচিত ছিলেন। তাই বিজিত রাজ্যের ভূ-খন্ড সমূহ নিজেদের দখলে নিয়ে উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে সামন্তপ্রভু ও বিপুল সংখ্যক কৃষককে ভূমিদাসে পরিনত করেছিল। এভাবে বিভিন্ন প্রথার মাধ্যমে সামন্ত প্রথা বিকাশ লাভ করতে থাকে।

উরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সামন্ত প্রথা এমন এক প্রকার ভূমি ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিগত শাসন, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা ও বিশেষ এক জায়গীরদার ব্যবস্থার সমাবেশ রয়েছে। মধ্যযুগে যোগ্য শাসকের অভাবে সম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এরই প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সামন্ত প্রথার প্রবর্তন ঘটে।

No comments

Thanks for your Comment

Powered by Blogger.