রানী এলিজাবেথের বৈদেশিক নীতি
১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেরী টিউডরের মৃত্যুর পর বৈমাত্রেয় ভগ্নি এলিজাবেথ ২৫ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। রানী এলিজাবেথ ছিলেন অষ্টম হেনরীর রানী এ্যানবোলিনের কন্যা। তার পিতা অষ্টম হেনরী পোপের অনুমতি না নিয়ে এ্যানবোলিনকে বিবাহ করেছিলেন। এ জন্য ক্যাথলিকদের দৃষ্টিতে এলিজাবেথ ছিলেন পিতার অবৈধ সন্তান। সুতরাং তাদের মতে সিংহাসনে এলিজাবেথের কোন অধিকার নেই। কিন্তু তারা এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণ কালে তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এলিজাবেথের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ এবং তিনি বিভিন্ন সময় নানা প্রকার বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সুতরাং অতিঅল্প বয়স হতে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে অত্যান্ত সতর্কতারর সাথে চলতে হয়েছিল।
এলিজাবেথের পররাষ্ট্রনীতিঃ এলিজাবেথ
যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন ইংল্যান্ডের অবস্থা সব দিক দিয়ে শোচনীয় ছিল। তাছাড়া
এলিজাবেথের নিজের অবস্থা সংকটাপন্ন। কারন স্কটরানী মেরী তার জন্মের বৈধতা অস্বীকার
করে ইংল্যান্ডের এর সিংহাসন দাবী করছিলেন। এলিজাবেথ ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি
মোকাবেলা করার জন্য বৈদেশিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেন। তাই এলিজাবেথ
ইংল্যান্ডকে যুদ্ধ থেকে দূরে এবং বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সক্ষম
হন।
স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক
এলিজাবেথের বিবাহ প্রস্তাবঃ সিংহাসন লাভের পর থেকেই এলিজাবেথ স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তিনি জানতেন যে তার সিংহাসন আরোহণ কালে ইংল্যান্ডের অত্যান্ত দূর্বল ছিল এবং সেই অবস্থায় তিনি কোন ক্রমেই স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে পারেন না। তাছাড়া ইংল্যান্ড ইতিপূর্বেই ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ড মিলিত হওয়ার সম্ভবনা ছিল। এ অবস্থায় স্পেনের সাথে যুদ্ধ বাধানো মারাত্মক ভূল হবে। এলিজাবেথ দ্বিতীয় ফিলিপের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তার নিকট বিবাহের প্রস্তাব দেন। ফলে দ্বিতীয় ফিলিপ এলিজাবেথের সাথে বিয়ের সম্ভবনার কথা স্বরণ করে তাকে নানা ভাবে সাহায্য সহযোগীতা করতে শুরু করেন। তিনি ইংল্যান্ডে স্পেনীয় রাষ্ট্রদূতকে এলিজাবেথের নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে দুদেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে এবং একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কারণঃস্পেন রাজ দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ড লাভ করতে আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি মেরীর মৃত্যুর পর এলিজাবেথ কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে এলিজাবেথ নিজের প্রয়োজনে স্পেনের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য এ বিবাহ প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি স্পেন রাজকে বিয়ে করেন নি। এ জন্য দ্বিতীয় ফিলপ এলিজাবেথের উপর অসন্তুষ্ট হন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
দ্বিতীয় ফিলিপ ক্যাথলিক ধর্মমতের একজন উগ্র সমর্থক ছিলেন। তাই প্রোটেস্ট্যান ইংল্যান্ডকে ক্যাথলিক মতে ফিরিয়ে আনতে তার যথেষ্ঠ আগ্রহ ছিল। তাছাড়া পোপ অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ইংল্যান্ড আক্রমণে প্রোরোচিত করেছিলেন।
নেদারল্যান্ড এর অধিবাসীগণ স্বাধীনতা লাভের জন্য স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করলে এলিজাবেথ গোপনে তাদের কে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন। এ কারনে এলিজাবেথের প্রতি দ্বিতীয় ফিলিপ অত্যান্ত ক্ষ্রুদ্ধ হন।
আমেরিকা মহাদেশে স্পেনের বিভিন্ন সাম্রাজ্য ছিল। বহু কাল থেকে স্পেনীয়গণ সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। পড়ে ইংরেজগণ স্পেনীয় বাণিজ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। ফলে স্পেনীয় বণিকদের সাথে ইংরেজ বণিকদের প্রায় যুদ্ধ হত। দ্বিতীয় ফিলিপ ইংরেজদের কে আমেরিকার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতে নিষেধ করেন। কিন্তু স্যার জন হকিন্স, স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক প্রমুখ ইংরেজ বণিকগণ স্পেনীয় সরকারের আদেশ অমান্য করে ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে থাকে। এতে ক্ষ্রুদ্ধ হয়ে স্পেন রাজ এলিজাবেথের নিকট অভিযোগ উত্থাপন করেন। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। বরং এলিজাবেথ এসব বণিকদের উচ্চ খেতাব দিয়ে তাদেরকে আরও উৎসাহিত করেন।
ফিলিপের ইংল্যান্ড আক্রমণের সিন্ধান্ত ও ড্রেকের কার্ডিজ বন্দর আক্রমণঃ ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্কটরানী মেরীকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করায় দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ডের উপর ক্ষ্রুদ্ধ হন। কারন মেরী প্রাণদন্ডের ক্ষেত্রে সকল ষড়যন্ত্রের মূলে ছিলেন এলিজাবেথ। তাই তিনি ইংল্যান্ড আক্রমণের চুড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্পেন রাজ দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ড আক্রমণের অভিপ্রায়ে কার্ডিজ বন্দরে একটি নৌবহর প্রস্তুত করে রাখেন। কিন্তু নির্ভিক ড্রেক অতর্কিত আক্রমণ এর মাধ্যমে কার্ডিজ বন্দরে প্রবেশ করে স্পেনীয় জাহাজ গুলো ধ্বংশ করে দেন। ফলে ফিলিপকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আরও একবছর অপেক্ষা করতে হয়। ইতিমধ্যে এলিজাবেথ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পান।
পুনরায় স্পেনীয় নৌবহর নির্মাণ ও ইংল্যান্ড আক্রমণের সিন্ধান্তঃ ড্রেকের আক্রমনের পর ফিলিপ পুনরায় নৌবহর নির্মাণের আদেশ দেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে নৌবহরকে পোপের আশির্বাদ নিয়ে ইংল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা করে। ডিউক অব মেডিনা সিডোনিয়া এর অধিনায়ক ছিলেন। ইংল্যান্ডকে ক্যাথলিক ধর্মে দিক্ষিত করার জন্য বহুসংখ্যক পাদ্রী এর সঙ্গে যাত্রা করেন। তাছাড়া স্পেনীয় সেনাপতি পার্মা কয়েক হাজার সৈন্য সহ নেদারল্যান্ড এ অপেক্ষা করছিলেন। ফিলিপের আক্রমণ পরিকল্পনার খবর পেয়ে সমগ্র ইংল্যান্ড যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
ইংল্যান্ড ও স্পেনীয় নৌবহরের যুদ্ধঃ স্পেনীয় নৌবহর আর্মাডাইংল্যান্ডকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ইংলিশ চ্যানেলের পথে নেদারল্যান্ড এর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইংলিশ নৌবাহিনী একে অগ্রসর হতে দিয়ে পিছন দিক হতে আক্রমণ করে। এতে আর্মাডা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় এবং ছয়দিন যুদ্ধ চালার পর নেদারল্যান্ড এ অবস্থানরত ডিউক অব পার্মার সৈন্যদলের সাথে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে কোন রকমে ক্যালে বন্দরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কিন্তু পার্মার সৈন্যদল নেদারল্যান্ড এর ডাচ বিদ্রোহী দের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পরায় আর্মাডার সাতে মিলিত হতে পারল না। এ অবস্থায় ইংরেজরা আটটি ছোট জাহাজে অগ্নি সংযোগ করে স্পেনীয় বহরের মধ্যে প্রবেশ করে। স্পেনীয়দের মধ্যে ভীষন আতংক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং স্পেনীয় বহর প্রেতাশ্রয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
গ্রেভেলিনসের যুদ্ধ ও আর্মাডার পরাজয়ঃ এছাড়া গ্রেভেলিনসের যুদ্ধে আর্মডা মারাত্মক ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে থাকে। ইংলিশ নৌবহর বহুদূর পর্যন্ত তা অনুস্বরণ করতে থাকে। স্কটল্যান্ড প্রদক্ষিণ করে দেশে ফেরার পথে তুমুল ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে আর্মাডার আরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
স্পেনীয় আর্মাডার পরাজয়ের ফলাফলঃ স্পেনীয় আর্মাডার পরাজয় ইংল্যান্ডের ইতিহাসে মোর পাল্টিয়ে দেয়। এর ফলে ইংল্যান্ডের উপর বৈদেশিক আক্রমণের আশংকা দূরীভূত হয় এবং ইউরোপে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। দেশের অভ্যান্তরে এলিজাবেথ রোমান ক্যাথলিকদের হাত হতে রক্ষা পায় ও প্রোটেস্ট্যান মতবাদ চালু করতে সক্ষম হন। এছাড়া আর্মাডার অপ্রত্যাশিত পতনের ফলে স্পেনীয় শক্তি প্রায়ই চুর্ণ হয়ে যায় এসময় হতে সমুদ্রে স্পেনের আধিপত্য বিনষ্ট হয় এবং তদস্থলে ইংল্যান্ডের প্রধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ব বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের আধিপত্য স্থাপন এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথ উম্মুক্ত হয়।
ইঙ্গ-স্পেনীয় যুদ্ধের অবসানঃ স্পেনীয়
আর্মাডার পরাজয়ের পরেও ইঙ্গ-স্পেন যুদ্ধ এলিজাবেথের রাজ্যের প্রায় শেষ পর্যন্ত
অব্যাহত ছিল। ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে ইংলিশ ও স্পেনীয় নৌবহরের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এতে
ইংলিশ নৌবহর রিভেঞ্জ স্পেনীয়দের হাতে বন্দি হয়। স্পেনীয় নৌবহরের ও অনেক ক্ষতি
সাধিত হয়। অতঃপর ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ইঙ্গ-স্পেন
যুদ্ধের অবসান ঘটে।
উপসংহারে বলা যায় যে, এলিজাবেথের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কোন বাধাধরা নীতি ছিল না। সাধারণত তিনি সুবিধাবাদী নীতি অনুস্বরণ করেন। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি ফ্রান্স ও স্পেনের দ্বন্দের সুযোগে একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বদা নিয়োজিত রাখতেন।
No comments
Thanks for your Comment